Je Prem Esechilo | যে প্রেম এসেছিল | Yash Rohan | Tanjim Saiyara Totini | New Bangla Natok 2023
ভূমিকা: শহুরে ক্যানভাসে আঁকা এক প্রেমের গল্প
প্রতিটি মানুষের জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যা তার ভাবনার জগতকে চিরতরে বদলে দেয়। কিছু প্রেম আসে ঠিক কালবৈশাখী ঝড়ের মতো, যা এসে সবকিছু তছনছ করে দিয়ে যায়, রেখে যায় কেবল একরাশ শূন্যতা। আবার এমনও কিছু প্রেম আছে, যা শরতের ভোরের স্নিগ্ধ বাতাসের মতো অলক্ষ্যে এসে হৃদয়ের প্রতিটি কোণে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। "যে প্রেম এসেছিল" নাটকটি ঠিক তেমনই এক প্রেমের গল্প, যা কোলাহলপূর্ণ শহরের বুকে দুটি ভিন্ন জগতের মানুষের অপ্রত্যাশিতভাবে এক হওয়ার এক গভীর এবং সংবেদনশীল কাহিনী। এই গল্প শুধু ভালোবাসার নয়, এই গল্প নিজেকে নতুন করে চেনার, নিজের সীমাবদ্ধতাকে জয় করার এবং ভালোবাসার জন্য সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর।
প্রথম পর্ব: বৃষ্টির বিকেল ও এক কাপ কফি
গল্পের প্রেক্ষাপট ঢাকা শহরের এক অভিজাত এলাকা। মুষলধারে বৃষ্টি নামায় শহরের গতি যেন হঠাৎই থমকে গেছে। জানালার কাঁচ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলের ধারা, আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে শহরের ব্যস্ততম ক্যাফেতে বাড়ছে মানুষের ভিড়। এই ভিড়ের মধ্যেই এক কোণের টেবিলে বসে ছিল তোতিনি (তানজিম সায়ারা তোতিনি)। তার সামনে খোলা স্কেচবুক আর হাতে ধরা পেন্সিল, কিন্তু তার মন পড়ে ছিল বাইরের বৃষ্টিতে। তোতিনি একজন শিল্পী, যার কাছে পৃথিবীটা রঙের এক বিশাল ক্যানভাস। সে এক আর্ট গ্যালারিতে কিউরেটর হিসেবে কাজ করে, কিন্তু তার আসল পরিচয় সে একজন স্বপ্নদ্রষ্টা।
ঠিক তখনই ক্যাফের দরজা ঠেলে প্রবেশ করে রোহান (ইয়াশ রোহান), একজন সফল আর্কিটেক্ট। তার জগৎটা চলে স্কেল, পরিমাপ আর কঠিন যুক্তির ওপর। সেদিন একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্লায়েন্ট মিটিং বৃষ্টির কারণে বাতিল হওয়ায় সে কিছুটা বিরক্ত ছিল। ক্যাফেতে কোনো টেবিল খালি না পেয়ে রোহানের চোখ আটকে যায় তোতিনির টেবিলে। দ্বিধা নিয়ে সে এগিয়ে গিয়ে অত্যন্ত ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করে, "কিছু মনে না করলে আমি কি এখানে একটু বসতে পারি? আসলে আর কোনো জায়গা নেই।" তোতিনি বই থেকে মুখ তুলে এক পলক তাকিয়ে সম্মতি জানায়। সেই এক পলকের দেখাই ছিল দুটি ভিন্ন জগতের প্রথম সংযোগ। কোনো কথা না হলেও, দুজনের মনের মধ্যে বয়ে গিয়েছিল এক অজানা স্রোত। রোহান দেখছিল তোতিনির স্কেচবুকের একটি অসমাপ্ত মুখের ছবি, আর তোতিনি দেখছিল রোহানের চোখেমুখে লেগে থাকা পেশাগত জীবনের ক্লান্তি আর তার ভেতরের এক গভীর মায়া।
দ্বিতীয় পর্ব: শিল্পের সাঁকো পেরিয়ে হৃদয়ের গভীরে
নিয়তি বোধহয় তাদের জন্য অন্য কিছুই ভেবে রেখেছিল। কয়েকদিন পর, তোতিনির আর্ট গ্যালারিতে একটি নতুন প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। সেই প্রদর্শনীর প্রধান অতিথি হিসেবে রোহানের আগমনের কথা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। রোহানকে দেখে তোতিনির অবাক হওয়ার পালা। রোহানও তোতিনিকে দেখে মৃদু হাসে, যেন পুরনো কোনো চেনা মানুষকে খুঁজে পেয়েছে। রোহান তোতিনির একটি ছবির সামনে এসে দাঁড়ায়, যেখানে ক্যানভাসে ছিল একলা পথের দিকে তাকিয়ে থাকা এক নারীর ছবি, যার চোখে ছিল অপেক্ষা আর স্বপ্ন। রোহান: "আপনার কাজের মধ্যে এক অদ্ভুত গভীরতা আছে। মনে হচ্ছে, এই ছবিটা শুধু রং-তুলির আঁচড় নয়, এর ভেতরে একটা আস্ত জীবন লুকিয়ে আছে। আপনি কি সবসময় মানুষের ভেতরের গল্প আঁকার চেষ্টা করেন?"
রোহানের এই প্রশ্নে তোতিনি মুগ্ধ হয়। এই প্রথম কেউ তার শিল্পের পেছনের দর্শনটা এত সহজে বুঝতে পারল। সে উত্তর দেয়, "আমি আসলে তাই চেষ্টা করি। আমার কাছে প্রতিটি মানুষই এক একটি রহস্যময় গল্প।" সেদিন থেকেই শুরু হয় তাদের পথচলা। আর্ট গ্যালারি থেকে শুরু করে কফি শপ, পুরনো বইয়ের দোকান, এমনকি শহরের নীরব লেকের পাড়ে বসে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করত। রোহান তার কাঠখোট্টা জীবনের বাইরে এক নতুন পৃথিবীর সন্ধান পায়, যেখানে যুক্তি নয়, অনুভূতিই শেষ কথা। আর তোতিনি তার কল্পনার জগতে এমন একজনকে খুঁজে পায়, যে তার স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সাহস জোগায়। তাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের সীমানা পেরিয়ে কখন যে ভালোবাসার গভীর সমুদ্রে পৌঁছে গিয়েছিল, তা তারা নিজেরাও টের পায়নি।
তৃতীয় পর্ব: পারিবারিক সংঘাত ও সন্দেহের কালো মেঘ
কিন্তু স্বপ্নের পথচলা সব সময় মসৃণ হয় না। রোহানের পরিবার ছিল অত্যন্ত রক্ষণশীল এবং বনেদি। তার বাবা-মা তাদের ছেলের জন্য এমন একজন জীবনসঙ্গী চাইতেন, যে তাদের সামাজিক অবস্থানের সাথে মানানসই এবং পুরোপুরি সংসারী হবে। তোতিনির মতো একজন স্বাধীনচেতা, ক্যারিয়ারকেন্দ্রিক শিল্পীকে তারা নিজেদের পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিতে পারছিলেন না। রোহানের মা প্রায়ই তাকে বলতেন, "যে মেয়ে সারাদিন বাইরে বাইরে ঘোরে, সে সংসার কীভাবে করবে? ভালোবাসা দিয়ে জীবন চলে না, রোহান। বাস্তবতাকে বুঝতে শেখো।"
অন্যদিকে, তোতিনির জীবনেও ছিল এক চাপা ভয়। তার মায়ের একাকী জীবন তাকে শিখিয়েছিল যে, আবেগ প্রায়ই মানুষকে ভুল পথে চালিত করে। তিনি চাইতেন, তার মেয়ে যেন এমন কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেয়, যে তাকে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে পারবে। রোহানের পরিবারের মনোভাব জানার পর তার ভয়টা আরও বেড়ে যায়। এই পারিবারিক চাপের মাঝেই তাদের সম্পর্কে এক নতুন ঝড় আসে। রোহানের অফিসে তার জীবনের বান্ধবী নীলা আর্কিটেক্ট হিসেবে যোগ দেয়। নীলা প্রথম থেকেই রোহানকে পছন্দ করত। একদিন সন্ধ্যায় তোতিনি রোহানকে চমকে দেওয়ার জন্য তার অফিসে যায়। সে দরজার বাইরে থেকে দেখতে পায়, নীলা একটি ডিজাইনের ব্যাপারে রোহানের খুব কাছে ঝুঁকে কথা বলছে। যদিও মুহূর্তটা ছিল পুরোপুরি পেশাগত, কিন্তু দূর থেকে দেখে তোতিনির মন সন্দেহের কালো মেঘে ঢেকে যায়। তার মনে হতে থাকে, হয়তো রোহানের পরিবার নীলাকেই তার জন্য যোগ্য মনে করে। সেদিন রাতে অভিমানে আর কষ্টে তার বুক ফেটে যাচ্ছিল।
চতুর্থ পর্ব: ভাঙা বিশ্বাস জোড়া লাগানোর লড়াই
তোতিনি নিজেকে গুটিয়ে নেয়। সে রোহানের ফোন ধরা বন্ধ করে দেয়, মেসেজের উত্তর দেয় না। রোহান কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, তাদের মধ্যে হঠাৎ কী এমন হলো। কয়েকদিন পর, রোহান প্রায় দিশেহারা হয়ে সরাসরি তোতিনির আর্ট গ্যালারিতে হাজির হয়। সেখানে দুজনের মধ্যে এক আবেগঘন কথোপকথন হয়। রোহান: (আর্তস্বরে) "আমার ভুলটা কোথায়, তোতিনি? একবার শুধু বলো, কেন নিজেকে এভাবে দূরে সরিয়ে নিচ্ছ? তোমার নীরবতা আমাকে প্রতি মুহূর্তে শেষ করে দিচ্ছে।" তোতিনি: (চোখের জল আড়াল করে) "কিছু সম্পর্ক শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাওয়া ভালো, রোহান। তোমার আর আমার জগৎটা সম্পূর্ণ আলাদা। আমি তোমার পরিবারের দেওয়া কষ্ট সহ্য করতে পারব না, আর আমার মায়ের ভয়কে সত্যি প্রমাণ করতে চাই না।"
রোহান বুঝতে পারে, সমস্যাটা শুধু তার পরিবারকে নিয়ে নয়, বরং আরও গভীর কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। সে তোতিনিকে নীলার বিষয়টি সম্পূর্ণ খুলে বলে এবং এটা প্রমাণ করে যে তাদের মধ্যে পেশাগত সম্পর্ক ছাড়া আর কিছুই নেই। রোহান তাকে বোঝায় যে, ভালোবাসা মানে শুধু একসাথে স্বপ্ন দেখা নয়, বরং কঠিন সময়ে একে অপরের বিশ্বাস হয়ে ওঠা। রোহানের চোখের সততা দেখে তোতিনির ভেতরের অভিমানের বরফ গলতে শুরু করে। সে উপলব্ধি করে, ভালোবাসার সবচেয়ে বড় ভিত্তি হলো বিশ্বাস, যা সে প্রায় হারাতে বসেছিল।
শেষ পর্ব: যে প্রেম এসেছিল পূর্ণতা পেতে
নাটকের ক্লাইম্যাক্স ছিল অসাধারণ। রোহান তার বাবা-মাকে তার ভালোবাসার গভীরতা বোঝানোর জন্য এক অভিনব পথ বেছে নেয়। সে তার ডিজাইন করা একটি স্বপ্নের বাড়ির থ্রিডি মডেল তৈরি করে, যার প্রতিটি অংশ ছিল তোতিনির শিল্পভাবনা দ্বারা অনুপ্রাণিত। বাড়ির বসার ঘরের দেয়াল থেকে শুরু করে শোবার ঘরের ল্যাম্পশেড, সবকিছুতেই ছিল তোতিনির আঁকা ছবির ছাপ। মডেলটি দেখিয়ে রোহান তার বাবা-মাকে বলে, "এই বাড়িটা ছিল আমার স্বপ্ন, কিন্তু এটা ছিল শুধু ইট-পাথরের একটা কাঠামো। তোতিনি এসে তার ভালোবাসা আর শিল্প দিয়ে এই নিষ্প্রাণ কাঠামোতে প্রাণ দিয়েছে। ও শুধু আমার প্রেমিকা নয়, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। তোমরা যদি আজ ওকে ফিরিয়ে দাও, তাহলে আমার এই স্বপ্নের আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।"
ছেলের চোখের আকুতি আর তার ভালোবাসার এমন শৈল্পিক প্রকাশ দেখে রোহানের বাবা-মায়ের কঠিন মন অবশেষে গলে যায়। তারা বুঝতে পারেন, তাদের ছেলের সুখ এই মেয়েটির সাথেই জড়িত। অন্যদিকে, তোতিনিও তার মাকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, সব প্রেমের পরিণতি এক হয় না। তাদের ভালোবাসাটা ভয় পেয়ে পালিয়ে যাওয়ার জন্য আসেনি, বরং একে অপরকে আগলে রেখে সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করার জন্যই এসেছে। গল্পের শেষে, সেই বৃষ্টিভেজা বিকেলে, সেই ক্যাফেতে, যেখানে তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল, রোহান আর তোতিনি আবার একসাথে বসে। তাদের হাতে ছিল গরম কফির মগ, আর চোখে ছিল একসাথে একটি নতুন সুন্দর জীবন শুরু করার স্বপ্ন। যে প্রেম একদিন বৃষ্টির মতো অপ্রত্যাশিতভাবে এসেছিল, তা আজ তাদের দুজনের জীবনকে ভালোবাসার চিরস্থায়ী রঙে রাঙিয়ে দিয়ে গেছে।
ডিসক্লেমার: এই গল্পটি নাটকের কাহিনীর উপর ভিত্তি করে একটি কল্পিত রচনা। থাম্বনেইলটি শুধুমাত্র তথ্য পরিবেশনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে।
রোহান এবং তোতিনির ভালোবাসার এই জার্নিটা কি আপনার মন ছুঁয়ে গেছে? আপনার কি মনে হয়, বর্তমান সময়ে বিশ্বাস আর অনুপ্রেরণাই একটি সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার সবচেয়ে বড় শক্তি? আপনার জীবনের মূল্যবান ভাবনাটি নিচের কমেন্ট বক্সে জানাতে ভুলবেন না। আপনার প্রতিটি কমেন্টই আমাদের অনুপ্রেরণা!